বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বংশাল এলাকায় অবিস্থত সনাতন হিন্দু হরিজন সম্প্রদায়ের ৬০টি ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ায় তীব্র প্রতিবাদ করেছে আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম হিন্দু সংগঠন ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ । সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে কোনো ভাবেই হরিজনদের উতখাত করা যাবে না।যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের ওই স্থানেই পুনর্বাসন করতে হবে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে এস্টোরিয়া, কুইন্স এবং নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত বাংলাদেশ কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে ওই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। আমেরিকার হিন্দু নেতারা এসময় কন্স্যুলারকে একটি স্মারক লিপিও প্রদান করেন। যাতে হরিজনদের আবাসন সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএস’ গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান প্রভাত দাস , সভাপতি ভজন সরকার,সাধারন সম্পাদক রামদাস ঘরামী, সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার সাহা, কেন্দ্রীয় নেতা নবেন্দ দত্ত, সুশীল সিনহা, ভবতোষ মিত্র, জয়দেব গাইন , পরেশ ধর, দিপঙ্কর সাহা, প্রসেনজিত বর্মন, কিষাণ দাস, দিনেশ মজুমদার, জনপ্রিয় ফটোগ্রাফার বিধান চন্দ্র পাল প্রমুখ। অনুস্ঠান সঞ্চালনা করেন ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ’র সাধারণ সম্পাদক রামদাস ঘরামী। গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ডা. প্রভাত দাস ক্ষোভের সঙ্গেই বলেছেন, যে মাত্র দুই দিন আগে নোটিশ দিয়ে একটি স্থায়ী কলোনী ভেঙে দেওয়া যায়না। একটি জনজাতিকে রাতারাতি মুছে দেওয়া যায়না। এটা অন্যায়। তিনি বলেন, বংশালের এই মিরনজিল্লা হরিজন পল্লির সুদীর্ঘ একটি ইতিহাস রয়েছে। বংশ পরম্পরায় এরা ৪০০ বছর  থেকে এখানে বসবাস করে আসছে। এখন উন্নয়নের নামে তাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হলো । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে মানবতার মা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। রাতারাতি এই ৫০০ পরিবারকে উচ্ছেদ শুরু করায় তার সেই মানবতা কোথায় গোলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজা শেখ তাপস এখন ঢাকা দক্ষিনের মেয়র ,তিনিই যদি সংখ্যালঘু হরিজনদের এভাবে উচ্ছেদ করেন তাহলে সনাতন হিন্দুরা কার কাছে বিচার পাবে, আশ্রয় পাবে। তিনি বলেন, হরিজনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ করা হলে আমেরিকার হিন্দুরা তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলবে। সংগঠনের উপদেস্টা নবেন্দ দত্ত বলেন, হরিজনদের উচ্ছেদ করতে হলে অবশ্যই বিকল্প আবাসন ব্যবস্থা করতে হবে। এ অন্যায় আমারা সারা বিশ্বের হিন্দুরা মেনে নেবো না।ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ’র সভাপতি ভজন সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকেন তাতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আপনি কেনো মৌলবাদিদের খুশি করতে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালাছেন।তাদের বাসস্থান কেড়ে নিচ্ছেন।মি. সরকার আরো বলেন, বাংলাদেশের কতিপয় সংস্থা, প্রতিস্ঠান হিন্দুদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কি করে হিন্দুদের দেশ ছাড়া করা যায় সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। হরিজনদের উচ্ছেদ তারই একটা অংশ।  তিনি এই উচ্ছেদ অভিযানের নিন্দা করে বলেন, যদি হরিজনদের বাংলাদেশে থেকে নিশ্চিন্ন করার ষড়যন্ত্র করে থাকেন কোনো ব্যক্তি তাহলে তা ভুল করছেন। আমরা জাতিসংঘে এই উচ্ছেদ অভিযানের মতো অমানবিক কার্যক্রম বন্ধে প্রয়োজন হলে চিঠি দেবো। আমেরিকায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবো।হরিজনদের বিকল্প আবাসন সৃষ্টি না করে কোনো ভাবেই ওই স্থান থেকে উচ্ছেদ না করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন ভজন সরকার।  সহ-সভাপতি ভবতোষ মিত্র বলেন, বাংলাদেশে যদি বহিরাগত পাকিস্তানী  বিহারিরা সরকারের সুবিধা নিয়ে বসবাস করতে পারে তাহলে হরিজনরা কেনো ৪০০ বছরের ভিটেমাটিতে থাকতে পারবে না। তাদের উচ্ছেদ করা অন্যায়।

ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ’র সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম সাহা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল হরিজনরা। যুদ্ধে ১০ জন হরিজন শহিদ হয়েছিল।স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদান আছে। ৪০০ বছর  থেকেই অবদান রাখছে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায়। অথচ আজ তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে । ক্ষোভ প্রকাশ করে মি. উত্তম সাহা বলেন, আওয়ামী লীগ  হিন্দুদের ভোট ব্যাংক মনে করে । হিন্দুরাও ঢালাওভাবে এই দলটিকে সমর্থন করে , ভোট দেয়। সেই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে কেনো বাংলাদেশে একের পর এক হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে, হিন্দুদের বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে , এই উত্তর কে দেবে ?সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম সাহা প্রশ্ন রেখে বলেন, অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে আবাসন দিচ্ছে সরকার, খাদ্য দিচ্ছে অথচ ৪০০ বছর যে হরিজন পরিচ্ছন্নতা দিলো তাদের বসত ভিটা ৪৮ ঘন্টা নোটিশে উচ্ছেদ করা হলো। তিনি ঢাকা দক্ষিনের মেয়রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, মেয়র বঙ্গবন্ধু পরিবারেরই সদস্য। জাতির পিতার উত্তরসূরি। তিনিই যদি কোনো কিছু না যেনে এভাবে সনাতন হিন্দুদের কাঁচা বাজার বসানোর কথা বলে বসত ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেন তাহলে হিন্দুদের ভরসার যায়গা আর থাকলো না।আমেরিকার সকল হিন্দুদের এই প্রতিবাদে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের উচিত হবে যতদিন হরিজনদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত না হবে ততদিন কন্স্যুলারেটের সামনে অবস্থান কর্মসূচি এবং প্রতিবাদ সমাবেশ চালিয়ে যাওয়া অঙ্গিকার করা। আমরা বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর এই অন্যায় চাপিয়ে দিতে দেবো না। বাংলাদেশে ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ’র সমর্থক সংগঠন বিশ্ব হিন্দু ফেডারেশনের মহাসচিব শ্যামল কান্তি নাগ শুক্রবার উচ্ছেদ হওয়া হরিজনদের ওই মিরন জল্লা পল্লিতে গিয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন, হরিজনদের কান্না আর হতাশার চিত্র। স্থানীয় কাউন্সিলর আউয়াল এই উচ্ছেদের মাস্টার প্লানার। তার ৩৩ নং ওয়ার্ডের স্থানীয় কাচাবাজার সম্প্রসারনের জন্যই হরিজনদের ৬০টি ঘর ভেঙেছেন  আইন লঙ্ঘন করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি বিষয়ক কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবীর ভাষ্যমতে মাত্র ২৫/৩০ ঘর ভাঙার কথা। এবং তাদের পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু কোনো কাউন্সিলর ৬০ টি ঘর ভাঙলেন, এই নিদের্শ কি মেয়রের ছিল ? নাকি নিজের লাভের কথা চিন্তা করে হরিজন উচ্ছেদে নেমেছেন সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।মি. নাগ বলেছেন, কথিত মুঘল আমলে হিন্দী ভাষী  এই কানপুরী হরিজনদের বংশালে আনো হয়েছিল ৪০০ বছর আগে। আবাসন সুবিধা দেওয়ার শর্তে তারা বংশালের এই স্থানে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে এসেছিল।যখন এই দেশে মুঘলরা হরিজনদের এনেছিল তখন এই জমিজমা সম্পত্তি হিন্দুদেরই ছিল।তখন এই দেশ পাকিস্তান ছিলনা, বাংলাদেশেরও জন্ম হয়নি। আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশে সনাতন হিন্দু হরিজনদের সম্পত্তি ভিটেমাটি জবরদখল করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতিহাস খুঁজুন, মুঘল আমলে মিরন বাই নামে একজন বাইজী সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পী হিসিবে লখনৌ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তার জন্মস্থান কানপুরে হওয়ায় সেই জায়গা থেকে আসা এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি তার মমত্ববোধ ছিল। তিনি এই দেশ ছাড়ার আগে এই সম্পত্তি হরিজনদের কিনে দেন। তখন জমি পত্তন রেজিস্ট্রেশন না থাকায় আজ  রাজধানীর হাজার হাজার হরিজনদের বসত ভিটা থেকে উচ্ছেদের আতঙ্কে দিন কাটাতে হচ্ছে।মি. নাগ বলেছেন, শুধু হরিজন নয় সাধারণ হিন্দুদের সম্পত্তিও বেদখল করা হচ্ছে। জবর দখল করা হচ্ছে দেবত্তোর সম্পত্তি।

বার্তা প্রেরক:

উত্তম কুমার সাহা

সাংগঠনিক সম্পাদক

ইউনাইটেড হিন্দুস অব ইউএসএ